মব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হলে দেশে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হতে পারে, এমন আশঙ্কার কথাও বলছেন কোনো কোনো রাজনীতিক।
কারা ঘটাচ্ছে মবের ঘটনা
কখনও রাজনৈতিক, কখনও গোষ্ঠীগত বা ব্যক্তিগত প্রতিহিংসা থেকে কাউকে স্বৈরাচারেরে দোসর বা এ ধরনের ‘তকমা’ দিয়ে মব ভায়োলেন্স বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা হচ্ছে।
এ বছরের প্রথম ছয় মাসের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে এমন ধারণা পাওয়ার কথা বলছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
এ সব সংগঠনের তথ্য অনুযায়ী, কট্টরপন্থি ধর্মভিত্তিক কোনো কোনো গোষ্ঠী, যাদের রাজনীতিতে, সাধারণ মানুষের মাঝে তেমন অবস্থান নেই, এ ধরনের কিছু শক্তি ‘তৌহিদী জনতা’ বা এ ধরনের ব্যানারে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় বেশ কিছু মব সৃষ্টি করেছিল। ইসলামপন্থি কোনো কোনো দলেরও তাতে সমর্থন ছিল।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “কোনো শক্তি একের পর এক মব তৈরি করে দেশকে একটা পরিস্থিতির দিকে নিতে চাইছে, যাতে পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়।”
মব ভায়োলেন্সের ঘটনাগুলোর বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই রাজনীতি রয়েছে বলেই মানবাধিকার সংগঠনগুলোর তথ্যে দেখা যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির বিরুদ্ধে।
আর এনসিপির বিরুদ্ধেই অভিযোগের পাল্লাটা ভারি বেশি। যদিও দলটি অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। একইসঙ্গে তারা মবের ঘটনগুলোকে ‘জনরোষ’ বা ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ বলেও এক ধরনের ন্যারেটিভ দিচ্ছে।
কিন্তু এনসিপির নেতা-কর্মীদের মবের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার সর্বশেষ অভিযোগ নিয়েও ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।
কারণ তাদের মবের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের পটিয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
একজন মানবাধিকার কর্মী বলছেন, ঘটনাটি ছিল বিষ্মিত হওয়ার মতো। এনসিপি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু নেতা-কর্মী মব তৈরি করে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের একজন কর্মীকে ধরে চট্টগ্রামের পটিয়া থানায় নিয়ে যায় এবং তাকে গ্রেফতার করতে বলে।
তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা না থাকায় পুলিশ ওই ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেফতার করতে অপারগতা জানায়।
তখন এনসিপি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা বাগ্বিতণ্ডা থেকে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। পরে তারা থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার অপসারণ দাবি করে।
সেই দাবির মুখে কিন্তু ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়।
গত বছরের পাঁচই অগাস্টের পর থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমন আলোচিত বেশ কিছু ঘটনার অভিযোগ রয়েছে এনসিপি ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে।
জামায়াতের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধেও কয়েকটি ঘটনায় জড়িত থাাকার অভিযোগ রয়েছে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যালয়ে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে মব তৈরিতে ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে। জামায়াত ও ছাত্রশিবিরও কোনো মবের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ অস্বীকার করছে।
বিএনপির বিরুদ্ধেও মব ভায়োলেন্সে সম্পৃক্ততার অনেক অভিযোগ আলোচনায় এসেছে।
গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টায় পুরােনাে ঢাকায় স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের সামনে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে জনসমক্ষে পিটিয়ে ও পাথর দিয়ে বুক ও মাথা থেঁতলে দিয়ে হত্যা করা হয়।
যদিও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দলের চারজনকে সংগঠন থেকে স্থায়ীভাবে বহিস্কার করা হয়েছে।
কিন্তু এই ঘটনায় ব্যাপক সমালােচনার মুখে পড়েছে বিএনপি।
এর আগে গত জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার নুরুল হুদাকে পুলিশের কাছে তুলে দেওয়ার আগে জুতার মালা পড়িয়ে লঞ্চিত করা হয়। সেই মবের ঘটনায় বিএনপির একদল নেতা-কর্মীর সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।
সম্প্রতি ঢাকার মহাখালীতে যুবদলের স্থানীয় একজন নেতার সমর্থকেরা সেখানকার একটি রেস্টুরেন্টে হামলা চালায় এবং একজন নারীকে মারধোর করে। সেই ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে। যুবদলের ওই নেতাকে অবশ্য সংগঠন থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসি’র সঙ্গে আলাপকালে দাবি করেছেন, মবের মতো কর্মকাণ্ডকে তাদের দল কোনোভাবেই প্রশ্রয় দিচ্ছে না।
তিনি উল্লেখ করেন, গত দশ মাসে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর চার হাজারের বেশি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে বহিস্কারসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, দলের শাস্তিমূলক ব্যবস্থার পরও বিএনপির মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সামলানো যাচ্ছে না। তাদের অনেকে ব্যক্তি স্বার্থ ও প্রতিহিংসা থেকে দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলার মতো কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে।
কেন থামছে না
বড় অভিযোগ হচ্ছে, মবের ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে সরকার সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। গত ফেব্রুয়ারি মাসে যখন বুলডোজার মিছিলের ডাক দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ি ও বিভিন্ন স্থাপনায় দুদিন ধরে ভাঙচুর করা হয়েছে, তখন সরকারের নিরবতা ছিল লক্ষনীয়।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকারের ভূমিকা যেহেতু দৃশ্যমান ছিল না, সেকারণে তাদের এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আছে, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়েছে মানুষের মধ্যে।
কোনো কোনো রাজনৈতিক দলের নেতারাও বিশ্লেষকদের কথার সঙ্গে একই সুরে কথা বলছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সরকার না চাইলে মবের ঘটনা ঘটতে পারে না”।
তিনি এ-ও বলেন, “রিজিম পরিবর্তনের পর যার যার স্বার্থ থেকে মব ভায়োলেন্সের মতো ঘটনা ঘটাচ্ছে। এর পেছনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করে নির্বাচন প্রলম্বিত করার চিন্তাও থাকতে পারে”।
তবে, একটা পর্যায়ে এসে আলোচনা-সমালোচনার মুখে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে মবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সে অনুযায়ী সরকার কতটা কার্যকর ভূমিকা নিচ্ছে, সেই প্রশ্নও উঠছে।
অন্যদিকে,মব নিয়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর নেতাদেরও অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য দুই দলের সেই অভিযোগ অনেকটা একইরকম।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবিসিকে বলেন, একটা গণ অভ্যত্থানের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। এছাড়া পুলিশের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো সম্ভব হয়নি। মব থামাতে না পারার পেছনে এই বিষয়ও অন্যতম কারণ বলে তিনি মনে করেন।
জামায়াতে ইসলামীর জ্যেষ্ঠ্য নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়কে সরকারের গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “গত সাড়ে পনেরো বছরে যারা অপরাধ করেছেন, সরকার তাদের সঠিকভাবে আইনের আওতায় আনতে পারেনি। সেকারণে সে সময় নির্যাতিতদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে অনেক ক্ষেত্রে।”
জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির বক্তব্যও ভিন্ন কিছু নয়। দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব বিবিসি বাংলাকে বলেন, “একক কোনো গোষ্ঠী মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে না। অনেক মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আছে, স্থানীয়ভাবে অনেকের মধ্যে বিদ্বেষ আছে, এর থেকেও মবের ঘটনা ঘটছে।”
যদিও এই দলগুলোও মবের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের কথা বলছে। কিন্তু রাজনৈতিক দল, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ মবের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিলেও তারা কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখছে, এই প্রশ্ন তুলছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “প্রতিহিংসা থেকে মব ভায়োলেন্সের বেশিরভাগ ঘটনা ঘটছে। কোনো কোনো পক্ষ যখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে এসবের পক্ষে যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করছে, তখন দিনে দিনে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে।”
সুত্র: বিবিসি